সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অন্যদিকে ১৩টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও আশঙ্কার কথা জানিয়েছে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট প্রথম দফায় বন্যাকবলিত অঞ্চলে দ্বিতীয় দফার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট দিয়ে শুরু হওয়া বন্যার পানি এখন দেশের মধ্যাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকায় চলে এসেছে। মঙ্গলবার বন্যার পানি ঢাকার চারপাশের জেলাগুলোতে পৌঁছে যায়। ঢাকার নবাবগঞ্জ, দোহার ও মানিকগঞ্জের নিম্নাঞ্চল এখন বন্যার পানির নিচে। আগামী পাঁচদিনের মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে পানি চলে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নদীর পানির চাপে বিভিন্ন এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, ও সড়ক ভেঙে গেছে। সড়ক ও বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে
বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমিতে। তলিয়ে গেছ ধান, পাটসহ ক্ষেতের ফসল, রাস্তাঘাট, হাটবাজার।
এ দিকে গতকাল বুধবার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছেÑ গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, নাটোর, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, রাজবাড়ি ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদনদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকায় প্রধান নদনদীর পানি সমতল কমছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদী সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।
বগুড়া ও সারিয়াকান্দি : দ্বিতীয় দফায় যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়া জেলা তিনটি উপজেলা সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনটের চরাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা সারিয়াকান্দি। সারিয়াকান্দি উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়নের সবকটিতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। সারিয়াকান্দির ১২৩টি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। কোরবানির গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে অনেকেই। গরু ছাগল, মহিষের জীবন বাঁচাতে নিরাপদ ও উঁচু জায়গায় আশ্রয়ের সন্ধানে যাচ্ছে বানভাসি মানুষ।
নওগাঁ : হু-হু করে বাড়ছে নওগাঁর মান্দা উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আত্রাই নদীর পানি। এ নদীর পানি জোতবাজার পয়েন্টে এখন বিপদসীমার ১৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে আত্রাই ও ফকির্ণি নদীর উভয়তীরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৫০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে এ দুই নদীর উভয়তীরের সাতটি বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে দুই সহস্রাধিক মানুষ। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় দুর্গত এলাকার মানুষ বন্যানিয়ন্ত্রণ মূল বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। এসব এলাকার মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে। তাদের অভিযোগ, এ দুর্যোগ মুহূর্তে সহযোগিতা করছে না পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন। রাস্তায় তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে প্রথম দফার তুলনায় দ্বিতীয় দফার বন্যায় কৃষি ও মৎস্য খাতে বেশি ক্ষতির আশা রয়েছে। দিশেহারা হয়ে পড়ছে ১ লাখেরও অধিক পানিবন্ধী মানুষ। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কালীপদ রায় জানান, জেলায় ১ হাজার ১৫১জন মৎস্য চাষির ২ হাজার ১৭৯টি পুকুর প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৮৫ লাখ ১৫ হাজার টাকার মাছ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো: মোস্তাফিজার রহমান প্রধান জানান, প্রথম দফা বন্যায় ৬৮ হাজার কৃষকের ১০ হাজার হেক্টর জমি পানিতে নিমজ্জিত ছিল। এর মধ্যে ৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতি হয়। এতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৯০ কোটি টাকা। এবারে দ্বিতীয় দফার বন্যায় নতুন করে দেড় হাজার হেক্টরের বেশি ফসলি জমি নিমজ্জিত হয়েছে।
নীলফামারী : ডিমলায় তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় তিস্তার পানি নেমে ৫২ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
নাটোর : জেলার সিংড়ায় বিপদসীমা ছাড়ানো আত্রাই নদীর পানির চাপে শেরকোল ও তাজপুর ইউনিয়নের সংযোগ সড়কের টেমুক নওগাঁ ও রিফুজিপাড়া এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। বুধবার দুপুরে তীব্র বেগে পানি আসায় বাঁধটি ভেঙে যায়। বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে বাড়িঘর ও ফসলি জমিতে। বাঁধ কাম সড়কটি ভেঙে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দুটি ইউনিয়নের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ। হুমকির মুখে রয়েছে বাঁধ সংলগ্ন বাড়িঘরগুলো।
গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত এবং ভারী বর্ষণের কারণে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের ভাষারপাড়া সংলগ্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ চুঁইয়ে পানি অপর পাড়ে যাচ্ছে। এতে বাঁধটি হুমকির মুখে পড়েছে। বন্যার পানির তোড়ে বাঁধ ভেঙে ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া খোলাহাটি ইউনিয়নের কিশামত বালুয়া এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধও চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ায় তা হুমকির মুখে পড়েছে।
মুন্সীগঞ্জ : লৌহজং উপজেলার মাওয়া ও শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার লৌহজং উপজেলার মেদেনীম-ল ইউনিয়নের দক্ষিণ মেদেনীম-ল ও মামুদপট্টি গ্রামের শতাধিক বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। হাজারও মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধিতে ওই ইউনিয়নের কান্দিপাড়া-যশলদিয়া সড়ক প্লাবিত হয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
জামালপুর, ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ : যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতি। কয়েক জায়গায় সড়ক ও রেলযোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ায় অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জেলার ৫২ ইউনিয়নের ৫ লক্ষাধিক বানভাসির। বানভাসিদের দুর্ভোগ কমাতে জেলা প্রশাসন ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখলেও চাহিদার তুলনায় এর পরিমাণ অপ্রতুল বলে দাবি করছে জনপ্রতিনিধিরা। আর পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে- যমুনার পানি বৃদ্ধির হার তুলনামূলক কমতে থাকায় পানি না বাড়ার আশা করছেন তারা। এ দিকে দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের রেললাইন বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এতে বিপাকে পড়েছে ট্রেনের যাত্রীরা।
সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীতে আবারও পানি বাড়াতে নতুন করে বন্যার আশঙ্কা করছে পাউবো। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ২৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় পানি আরও বাড়তে পারে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে যমুনা পাড়ে বসবাসরত সিরাজগঞ্জের ৫টি উপজেলার মানুষ।
সুনামগঞ্জ : জেলার প্রধান নদী সুরমার পানি গতকাল বুধবার বিপদসীমার চার সেন্টিমিটার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারতের চোরাপুঞ্জির পাশাপাশি সুনামগঞ্জেও বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে। এতে জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
Leave a Reply